শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাহানারার প্রাপ্তিতে সফল হলো ‘আপন ঠিকানা’র ৫০তম পর্ব

রিজুয়ানা রিন্তী
১৪ অক্টোবর ২০২১ ১৯:১৪ |আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২১ ১৬:০৯
৫০তম পর্বে জাহানারা বেগম দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফিরে পেলেন তার পরিবার। ছবি : ভিডিও থেকে নেওয়া
৫০তম পর্বে জাহানারা বেগম দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফিরে পেলেন তার পরিবার। ছবি : ভিডিও থেকে নেওয়া

সফল হলো ‘আপন ঠিকানা’র অর্ধশত পর্ব। আরজে কিবরিয়ার উপস্থাপনা ও পরিকল্পনায় স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেডের অনুষ্ঠান ‘আপন ঠিকানা’ নিবেদন করেছে আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেড। ৫০তম পর্বে জাহানারা বেগম দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফিরে পেয়েছেন তার পরিবার। এটি ‘আপন ঠিকানা’র দর্শকদের জন্য অনেক কাঙ্ক্ষিত একটি অগ্রগতি। লাখ লাখ মানুষের প্রত্যাশা ছিল জাহানারা যেন তার পরিবারের সন্ধান পান।

‘আপন ঠিকানা’ ভিকটিম বা যিনি পরিবার খুঁজতে আসেন তার স্মৃতি থেকে কিছু তথ্য যেগুলো তিনি ছোটবেলা থেকে সারাজীবন মনে রেখেছেন, সেই তথ্যের ভিত্তিতে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচার করা। মানুষ ভালোবেসে সেই ভিডিও হাজার হাজার শেয়ার করতে থাকেন।

তারপর তথ্যের সঙ্গে মিলে যায় এরকম কোনো পরিবারকে যদি কেউ চেনেন বা সেই পরিবারের কেউ যদি হোন কিংবা আরও থার্ড পার্টির কেউ যদি হোন, তখন প্রতিষ্ঠানটির অফিসিয়াল ভলান্টিয়াররা ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য নেন। সব কিছু মিলে গেলে তারা অফিসে রিপোর্ট দেন।

এরপর অফিস থেকে আরেকবার অনুসন্ধান করে ‘আপন ঠিকানা’র উপস্থাপক ও পরিকল্পনাকারী আরজে কিবরিয়াকে চূড়ান্ত তথ্য নিশ্চিত করেন। তখন সবকিছু যাচাইবাছাই করে সঠিক মনে হলে ‘আরজে কিবরিয়া’ পেজে কিবরিয়া প্রাথমিক স্ট্যাটাস দিয়ে জানান যে এটা তার পরিবার হতে পারে। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার পরই আপডেট ভিডিও তৈরি করা হয়।

এ বিষয়ে আরজে কিবরিয়া বলেন, ‘আপডেট ভিডিওতে আমরা সমস্ত রকমভাবে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেই যিনি এখানে আসেন তার ওপর। তিনি যদি বলেন হ্যাঁ এটাই আমার পরিবার, তাহলে এটাই তার পরিবার। আর যদি বলেন যে না এটা তার পরিবার না, তাহলে তার পরিবার না। কিংবা যদি বলেন আমার সময় লাগবে তখন আমরা সময়ের হাতে ছেড়ে দেই।’

জনপ্রিয় এই উপস্থাপক আরও বলেন, ‘আপন ঠিকানা সিদ্ধান্ত দেয় না, সিদ্ধান্ত যিনি এখানে আসবেন তাকেই নিতে হবে। আরেকটা বিষয়, মানুষের প্রতি রেসপেক্ট রাখতে হবে, যিনি এই সময়ের ওপর দিয়ে গেছেন তিনি হয়তো মনে করতে পারেন এটা তার পরিবার। কিন্তু তিনি মন থেকে গ্রহণ করতে পারছেন না। বা যেকোনো কারণে সহজ হতে পারেন না। তাই বলছেন যে একটু সময় লাগবে। অথবা তিনি পরিবার হিসেবে একসেপ্ট করতে পারলেন। কিন্তু তার যে সিদ্ধান্ত তাতে যেন আমরা সম্মান জানাই। প্রত্যেক মানুষের অনুভূতি প্রকাশের ধরন ভিন্ন ভিন্ন, তাই তাদেরকে সেভাবেই গ্রহণ করতে হবে।’

গত ২০ সেপ্টেম্বর ‘আপন ঠিকানা’র ৬৮তম পর্বে জাহানারা বেগমের বেসিক ভিডিও তৈরি করা হয়। ভিডিওটি শেয়ার হয়েছিল ৮১ হাজার বার।

বেসিক ভিডিওতে জাহানারা জানিয়েছিলেন, এতিমখানা থেকে পাওয়া কাগজে জানতে পারেন তার বাবার নাম আব্দুল করিম, এটা হতেও পারে নাও হতে পারে। বাবা মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন। তিনি ফজর থেকে এশা পর্যন্ত সময় মসজিদেই কাটাতেন। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাবার জন্য খাবার নিয়ে যেতেন জাহানারা। মায়ের নাম শাহেদা, জাহেদা বা রাজিয়া হতে পারে।

তার ঠিকানা হতে পারে নোয়াখালীর সুধারামের দত্তেরহাট। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড়বোন হাসিনা, আর জাহানার ছোট বেলাল। জাহানার স্কুলে পড়তো, তবে কোন ক্লাসে পড়তো তা মনে নাই। বড় বোন অন্যের বাসায় কাজ করতো, মাঝে মাঝে বাড়ি আসতো।

একদিন এক লোক এসে কাজের জন্য মায়ের কাছ থেকে জাহানারাকে নিয়ে যান। ওই ব্যক্তি তাকে যে বাসায় দেন সেখানে থেকে ১০/১২ দিন পর সে পালিয়ে যায়। পরে একটি পরিবার তাকে থানায় দিয়ে আসে। থানায় কয়েকমাস তাকে নারীদের সঙ্গে হাজতে রাখা হয়। এরমধ্যেও তার পরিবারের কোনো খোঁজ না পাওয়ায় তাকে এতিমখানায় দিয়ে দেয় পুলিশ।

এতিমখানায় সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন জাহানারা। এখন তিনি চট্টগ্রামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। নিজের সন্তান জন্মের পর মাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি তার বেড়ে যায় বহুগুণে। তাই দত্তেরহাটে পোস্টার সাঁটিয়ে বিজ্ঞপ্তিও দেন তিনি। কোনো ফল পাননি তাতে। কিন্তু মায়ের জন্য হাহাকার থেকে আপন ঠিকানার দ্বারস্থ হয়েছেন জাহানারা। ফিরে পেতে চান নিজের মাকে। 

দীর্ঘ দিন পর বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) রাতে ‘আপন ঠিকানা’র অগ্রগতি (আপডেট) ভিডিও প্রচার করা হয়। এই ভিডিওটি পাঁচটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়। প্রথমে পরিচিতি ও অনুষ্ঠান পরিচালনার পদ্ধতি জানিয়ে আরজে কিবরিয়া বলেন, ‘ভিডিওটি প্রচারের পরে আপন ঠিকানার অফিসিয়াল ভলান্টিয়ার আরিফ চৌধুরী বিস্তারিত কাজ করেন। পরে তিনি জানান, সোর্সের বেসিসে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হই এটা জাহানারার পরিবার হতে চলেছে।’

দ্বিতীয় ধাপে জাহানারার সঙ্গে কথা হয়। কেন জাহানারার আপডেট ভিডিও পেতে এত দেরি হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার করোনা হয়েছিল। পরে ১৪ দিনের মতো কোয়ারেন্টিনে ছিলাম, রোববার জয়েন করেছি। আজ ছুটি নিয়ে আসলাম।’ পরিবার নিশ্চিত হওয়ার পর আপন ঠিকানা টিমের মহিউদ্দিন তাকে খবর দেন বলে জানান জাহানারা।

তৃতীয় ধাপে জাহানারাকে মেয়ে দাবি করা পরিবারটি আসে। এই পর্বে অফিসিয়াল ভলান্টিয়ার আরিফ চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক সোর্স মনির জাহানারার পরিবারকে চেনেন বলে জানান। পরে ফয়সাল নামে আরেকজনের নম্বর দেন উনার মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতেই মা কান্না করে বলেন, “এটাই আমার মেয়ে”।’

জাহানারার ভাই দাবি করা বেলাল বলেন, ‘তার বাবার নাম মোকলেসুর রহমান মিতু। মায়ের নাম শাহেদা খাতুন। বাড়ি অশ্বদিয়া ইউনিয়নের আজিজুল্লাহপুর গ্রাম। এটি নোয়াখালী জেলার মাইজদী কোর্ট থানায় পড়ে।’

জাহানারার মা ও তার ভাই জানান, বাবা প্যারালাইসড হয়ে গেলে সংসারে খুব অভাব দেখা দেয়। তখন সম্পর্কে চাচাতো বোন তার ননদের বাসার জন্য জাহানারাকে চায়। সেই বোনের বাসা থেকে তার ননদের বাসায় দেওয়ার পর কোনো এক কারণে জাহানারার গায়ে হাত তোলে তারা। এরপর কতদিন পর শোনা যায় সে হারিয়ে গেছে। আর্থিক অনটনের কারণে তখন তাকে সেভাবে খোঁজাও যায়নি। ২০০২ সালে মারা যান জাহানারার বাবা।

এরইমধ্যে প্রাথমিক সোর্স মনিরের সঙ্গে কথা বলেন আরজে কিবরিয়া। মনির সম্পর্কে জাহানারার খালাতো ভাই।

চতুর্থ ধাপে স্টুডিওতে ঢুকে জাহানারার মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তিনি প্রায় অচেতন হয়ে পড়েন। আরজে কিবরিয়া তাকে কাকি সম্বোধন করলে জাহানারাও ঘটনায় বিহ্বল হয়ে বলেন, ‘কাকি আছি তো, আছি তো আমি।

এ সময় কিবরিয়া জাহানারার মাকে নানা প্রশ্ন করে, কথা বলে স্বাভাবিক করেন। এরপর জাহানারার মা দাবি করে আসা ভদ্র মহিলাকে প্রশ্ন করতে থাকেন জাহানারা। কিন্তু তার হয়তো অনেক কিছু মনে নেই, তিনি সেই সময়ের অন্যসব কথা টুকটাক বলতে থাকেন।

এরপর তার ভাই বেলালকে স্টুডিওতে ডাকা হয়। তার সঙ্গে কথা বলে জাহানারার স্মৃতি মেলানোর চেষ্টা করা হয়। জাহানারার গোপন প্রশ্ন করা হয় তাকে। অনেক প্রশ্নের কাছাকাছি উত্তর দিতে পারেন বেলাল। ছোটবেলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন জাহানারা ও বেলাল।

কথোপকথনের একপর্যায়ে বেলাল বলেন, তারা বাবার আগেও এক সংসার ছিল। তখন জাহানারার মনে পড়ে যায় তাদের বড় এক ভাইয়ের নাম ‘মনা’। যে মাঝেমাঝেই তাদের বাড়িতে আসতো।

এরপর আর কোনো সংশয় থাকে না যে এটিই জাহানারার পরিবার। তবু জাহানারা আরও তথ্য যাচাই করতে থাকেন। মিলতে থাকে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর।

এরপর জাহানারা মেনে নেন এটিই তার পরিবার।

অনুভূতি জানতে চাইলে, নিশ্চুপ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন জাহানারা। এর মধ্য দিয়ে সফল হলো ‘আপন ঠিকানা’র ৫০তম পর্ব।

পঞ্চম ধাপে গেট টুগেদারে জাহানারা সবার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘উনিই আমার মা’। জাহানারার মা আনন্দে নাতিকে (জাহানারার বড় ছেলে) জড়িয়ে ধরে আদর করেন।

এ সময় ‘আপন ঠিকানা’র দর্শকদের, যারা তার বেসিক ভিডিও শেয়ার করেছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানান সদ্য আপন ঠিকানা খুঁজে পাওয়া জাহানারা।

সবশেষে আরজে কিবরিয়া বলেন, ‘আমাদের আরেকটা ভিডিও সফল, আলহামদুলিল্লাহ। আপন ঠিকানা মানে হচ্ছে একটি পরিবারে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষকে তার সেই ঠিকানায় ফেরানো। কোনো ঘটনার কারণে সে হয়তো আলাদা হয়ে গিয়েছিল, লম্বা একটা সময়ের পর সেই জায়গাটাতে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া। আমাদের আপন ঠিকানার রেজাল্টটা হলো- “অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল”।’




মন্তব্য করুন