শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যৌতুক প্রথা : আধুনিক সমাজের কলঙ্ক

অলোক আচার্য
২৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১২:২৭ |আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০২:৪৭
অলোক আচার্য, শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক
অলোক আচার্য, শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক

ধর্ষণ, বাল্যবিয়ের পাশাপাশি এক চিরন্তন অভিশাপ যা সমাজ আধুনিক হলেও কোনো লাভ হয়নি, শিক্ষিত সমাজও যাকে লাজলজ্জাহীনভাবে গ্রহণ করেছে এবং মেয়ের পিতাও ক্ষেত্রবিশেষে যা দেওয়া কর্তব্য বলে ধরেই নেয় সেই যৌতুক নামক নির্লজ্জ প্রথা আজও সমাজে গেঁথে আছে। এই যৌতুকের কারণে কত মেয়ের সংসার ভেঙে যায়, কত মেয়েকে নির্যাতন সহ্য করেও স্বামী দেবতার সংসার নামক নরকে থাকতে হয় অথবা মৃত্যুবরণ করতে হয় তার হিসাব কে রাখে!

কবি উইলিয়াম গোল্ডিং এর নারীর মূল্য কবিতার বাংলা অনুবাদ এরকম, ’আমি মনে করি, নারীরা একটু বোকা ধরনের হয়/ নইলে নিজেদের তারা পুরুষের সমান ভাববে কেন?/তারা পুরুষদের চেয়ে অনেক অনেক উন্নত এবং সর্বকালের জন্য,চিরকালের জন্য তাই সত্য।/নারীকে যাই দাও না কেন,সে তাকে বাড়িয়ে তুলবে।/যদি একটি শুক্রাণু দাও তাকে,সে দেবে সন্তান।/যদি একটি ঘর দিতে পারো তাকে, সে দেবে সংসার। মুদিও দোকান থেকে চাল ডাল,তেল নুন এনে দাও/সে তোমাকে চমৎকার খারার রান্না করে খাওয়াবে। একটি হাসির বিনিময়ে সে তোমাকে দেবে হৃদয়। সে ছোটকে বড়ো এবং কমকে বেশি করতে জানে। আরও দুলাইন রয়েছে। কবির নারী সম্পর্কিত বর্ণনায় এত উঁচুতে স্থান দেয়া হয়েছে যে প্রকৃতপক্ষে আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। আজকের এই সফলতায় যেমন পুরুষের অবদান রয়েছে তেমনি রয়েছে নারীদের অবদান। এই অবদান মনে করিয়ে দেয় ”এ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর-কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতার লাইন। এত অবদান সত্ত্বেও নারীদের ওপর নির্যাতন হয়। পৃথিবীর মঙ্গলময় সৃষ্টিতে নারীর রয়েছে সমান অবদান।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কিন্তু অতীত কাল থেকেই নারীরা অবহেলিত। অথচ আমরা নারীর উপর সহিংসতার আগে ভুলেই যাই যে, এরকমই কোন নারীর দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা তীব্র যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করার কারণেই আজ আমরা এই পৃথিবীতে। পৃথিবীতে আজ আমার যে অধিকার বলে চিৎকার করি সে অধিকার আদায়ের শুরুটা পৃথিবীর আলো দেখিয়ে একজন নারীই করেছে। দিন বদলের সাথে সাথে নারীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করে নিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। নারীর কাজ যে শুধু সন্তান জন্ম দান নয় তা বোঝাতেই কেটে গেছে অনেক বছর। নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। ঘরের কোণ থেকে বের হয়ে আজ মহাশূণ্য পর্যন্ত তাদের পদচিহ্ন রাখছে সফলতার সাথে। তবে কাজের ক্ষেত্র বাড়লেও কমেনি নারীর উপর সহিংসতার হার। বরং দিন দিন সহিংসতার নতুন নতুন ঘৃণ্য রূপ সমাজকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। যে সহিংসতা থেকে বাদ পরছে না তিন থেকে ত্রিশ বা তদুর্ধ্ব বয়সী নারীরা। তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে, বাসে গণধর্ষণ শেষে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

ধর্ষণ, বাল্যবিয়ের পাশাপাশি এক চিরন্তন অভিশাপ যা সমাজ আধুনিক হলেও কোনো লাভ হয়নি, শিক্ষিত সমাজও যাকে লাজলজ্জাহীনভাবে গ্রহণ করেছে এবং মেয়ের পিতাও ক্ষেত্রবিশেষে যা দেওয়া কর্তব্য বলে ধরেই নেয় সেই যৌতুক নামক নির্লজ্জ প্রথা আজও সমাজে গেঁথে আছে। এই যৌতুকের কারণে কত মেয়ের সংসার ভেঙে যায়, কত মেয়েকে নির্যাতন সহ্য করেও স্বামী দেবতার সংসার নামক নরকে থাকতে হয় অথবা মৃত্যুবরণ করতে হয় তার হিসাব কে রাখে! নারী উন্নয়নে যেসব বাধা আজও সমাজে বিদ্যমান তার মধ্যে অন্যতম হলো যৌতুক প্রথা। সেই আদিকাল থেকেই মেয়েকে বড় করার সাথে সাথে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে ছেলের বাবার হাত ভর্তি করে পণের টাকা দেওয়া যোগাড় করার। তারপরও লোভী শ্রেণি বারবার যৌতুকের চাপ দেয়। আধুনিক শিক্ষিত সমাজও এর লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায় আমাদের শিক্ষাই এক্ষেত্রে ব্যর্থ। কারণ বইয়ের পাতায় যৌতুকের কুপ্রথা নিয়ে লেখা আছে। তারপরও সেই পরিবারগুলো যৌতুন নেয় অথবা দেয়। আবার বহু পরিবারের গৃহবধু যৌতুকের শারীরিক ও মানসিকব দুই ধরনের পরিস্থিতিরই শিকার হন। মানবাধিকার সংগঠন ’অধিকার এর তথ্যে, ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল  (সেপ্টেম্বর)  পর্যন্ত দুই দশকে যৌতুকের কারণে ৩ হাজার ৪৩৭ জন গৃহবধুর মৃত্যু হয়। মৃত গৃহবধুর মধ্যে ছিল ৪৮ শিশু। যৌতুক দেওয়া-নেওয়া অপরাধ। এ রোগ বন্ধে আইন রয়েছে। তারপরও এত মৃত্যু এবং নির্যাতন যা খবরেই আসে না নিরবে সহ্য করে নেয় তা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে আমাদের শিক্ষা,সমাজ এবং আধুনিকতা নিয়ে। তথ্যে জানা যায়, ২০১০ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনে ২৩৫ গৃহবধুর মৃত্যু হয়। আর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৭ নারীর মৃত্যু হয়। তুলনামূলকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু উন্নতির এত দিন পরেও কেন একজন নারীকেও যৌতুকের কারণে প্রাণ দিতে হবে সেটাই প্রশ্নের বিষয়। এতসব করেও নারীরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সমান অংশীদার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অর্ধেক শক্তি।

নারী শক্তি বাদ দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা অসম্ভব। বাল্যবিয়ে, যৌতুক,ধর্ষণ,রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ,পরিবারে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। যৌতুক নামক এক ভয়ংকর প্রাচীন কিন্তু আধুনিক জীবনের আদিমতা থেকে আজও বের এ বিশ্ব বের হতে পারেনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে নারীরা। পাস করা শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও নারীর সংখ্যাই বেশি। ক্রমশই এই হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার অফিস আদালতে, গাড়িতে প্লেনে সবখানেই তারা দক্ষতার সাথে চাকরি করছে। তবুও যৌতুকের আগুনে পুড়তে হচ্ছে। একসময় মনে করা হতো শিক্ষিত হলেও বুঝি এ দায় থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। আসলে তা হচ্ছে না। কারণ মানসিকভাবে বদলাতে না পারলে কোনোদিনই যৌতুক প্রথার ঘৃণ্য প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব ধরনের পরিবারেই রয়েছে যৌতুকের অভিশাপ। আবার দেখা যায় যে মেয়েটি চাকরি করে সংসারে সাহায্য করছে তাকেও যৌতুকের জন্য দুচার কথা হজম করতে হচ্ছে। শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে মাসনিক অত্যাচার অনেক সময় তীব্র হয়ে ওঠে। প্রতি নিয়ত শশুড়বাড়ির মানুষের কাছে কথা শুনতে হয়। তীব্র এ কথা বাণে বিদ্ধ হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে খবর অবশ্য কেবল সেই ভুক্তভুগীই জানে। আর কারও জানার কথা না। এভাবে পশ্চাতে রেখে এগিয়ে চলার ভুল মানসিকতা আর কতকাল চলবে কে জানে? শিক্ষা আদৌ এর সমাপ্তি করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে? মূলত অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস করতে হবে নারীদের। সেই অভ্যাসটা পরিবার থেকেই তৈরি করতে হবে। পরিবারেই যদি মেয়েদের নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বা কোন পুরুষ সদস্যের সাথে তুলনায় খাটো করা হয় তাহলে সমাজেও তার প্রভাব পরে। যদিও এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইন আছে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শাস্তির ঘটনাও ঘটছে কিন্তু সমস্যা একেবারে শেষ হচ্ছে না। কবি কাজী নজরুলের নারী কবিতার অংশ দিয়ে শেষ করি। এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল/নারী দিল তাহে রুপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল। 

নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে একটি সম্পর্কের সূচনা হয়। পৃথিবীর পবিত্রতম সম্পর্ক। যে সম্পর্ক টিকে থাকে পারস্পরিক বিশ্বস্ততায়। সেখানে যৌতুক একটি অভিশাপ। যৌতুক সৃষ্টি হয় লোভ থেকে। যেখানে পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যেরও প্রচ্ছন্ন সায় থাকতে পারে। যদি পরিবার থেকেই যৌতুকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যায় তাহলে যৌতুক সমাজ থেকে বিলুপ্ত হবে। অনেক মেয়ের পরিবারই মানসিকভাবে ধরেই নেয় যে মেয়েকে বিয়ে দিতে যৌতুক বাধ্যতামূলকভাবে দিতেই হবে। যদি মেয়ে শিক্ষিত হয়, চাকরি করে তারপরও এই চিন্তা থেকে বের হতে পারে না। এই মানসিকতাই আরও পিছিয়ে দিচ্ছে যৌতুকমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা করতে। সময় এসেছে যেখানে বিয়ের মতো একটি সম্পর্ক শুরুর আগে কোনো দেনা-পাওনার হিসাব থাকবে না।

যৌতুকের জন্য কোনো মেয়েকে নির্যাতিত হতে হবে না। কাউকে আত্মহত্যা করতে হবে না।

 

অলোক আচার্য

শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক

পাবনা।



মন্তব্য করুন