মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ | ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল পরাক্রমশালী অটোমান সাম্রাজ্য

অনলাইন ডেস্ক
৭ মে ২০২২ ০৩:১৭ |আপডেট : ৭ মে ২০২২ ১১:৪৫
পরাক্রমশালী অটোমান সাম্রাজ্য
পরাক্রমশালী অটোমান সাম্রাজ্য

ইতিহাসে অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্তির পেছনে তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা কামাল আতাতুর্ক-এর নাম হয়তো বড় করে আসবে। কিন্তু প্রবল পরাক্রমশালী এই সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে ইয়াং টার্কদের ভূমিকা আর প্রথম মহাযুদ্ধের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোয় পড়াশোনা করে আসা তুরস্কের তরুণরা চাইছিলেন তুরস্কে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে। ইউরোপীয় অনেক দেশের মতো সুলতানের পদ হবে সাংবিধানিক, দেশ শাসন করা হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।

তরুণ তুর্কি আন্দোলন ১৯০৮ সাল সাংবিধানিক রাজতন্ত্র মেনে নিতে সুলতানকে বাধ্য করে। তখন চেম্বার অব ডেপুটি'জ গঠন করা হয়, যারা ভোটে নির্বাচিত হতেন।

কিন্তু তুরস্কের সালতানাতের বিদায়ের বড় ভূমিকা রাখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির সঙ্গে যোগ দেয়। ওই যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখে তুরস্ক। কিন্তু মহাযুদ্ধে পরাজয়ের পর বেশ কিছু অপমানজনক শর্ত মেনে নিতে হয় তুরস্ককে।

দি অটোমান পিপল অ্যান্ড দ্যা এন্ড অব এমপায়ার বইয়ে জাস্টিন ম্যাককার্থি উল্লেখ করেছেন, প্রথম মহাযুদ্ধের পর তাতে অংশ নেয়ার চড়া মূল্য দিতে হয় তুরস্ককে।

ট্রিটি অব সেভরেস অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য ভাগ হয়ে যায় ব্রিটেন আর ফ্রান্সে মধ্যে। ভূমধ্যসাগর উপকূল চলে যায় ইটালির হাতে, এজিয়ান সাগরের উপকূল যায় গ্রীসের দখলে, টার্কিশ প্রণালী দেয়া হয় আন্তর্জাতিক শক্তির হাতে। সেই সঙ্গে আর্মেনিয়ার বড় একটি অংশ স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃত পায়।

তুরস্কের জন্য অবমাননাকর এই চুক্তির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তরুণ তুর্কিরা। তারা বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করতে শুরু করে।

সেই বিদ্রোহ দমনে তুর্কী জেনারেল মুস্তাফা কামালকে আনাতোলিয়ায় পাঠান সুলতান ষষ্ঠ মেহমেদ।

কিন্তু সেখানে গিয়ে মুস্তাফা কামাল বরং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন নেতা হয়ে ওঠেন।


তুরস্কের স্বাধীনতা

আনাতোলিয়া নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য যখন গ্রীস বিশেষ একটি বাহিনী পাঠায়, তখন ১৯১৯ সালের মে মাসে শুরু হয় তুরস্কের স্বাধীনতার লড়াই।

জনগণের সমন্বয়ে তারা একটি বাহিনী তৈরি করে, যারা এক সাথে গ্রীস, আর্মেনিয়া, ফ্রান্স আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শুরু করে। যৌথ বাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসাবে তুরস্কের জাতীয়তাবাদীদের অর্থ ও সামরিক সহায়তা দেয় রাশিয়া।

জাতীয়তাবাদীরা আঙ্কারায় গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নামে পাল্টা সরকার তৈরি করে।

জাতীয়তাবাদী বাহিনী গ্রীক, ফরাসিদের তুরস্ক থেকে বিতাড়িত করে। কিন্তু ব্রিটিশরা তখনো ইস্তানবুলের দখল ধরে রেখেছিল।

চেম্বার অব ডেপুটি'র সদস্যরা ১৯২০ সালের ২৮শে জানুয়ারি গোপন সভায় মিলিত হয়। তারা ন্যাশনাল প্যাক্ট নামে এক সিদ্ধান্তে মুস্তাফা কামালকে চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সভা শেষ হওয়ার আগেই ব্রিটিশরা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর ইস্তানবুলে দমন পীড়ন অভিযান শুরু করে ব্রিটিশ বাহিনী।

তাদের পরামর্শে সুলতান ষষ্ঠ মেহমেদ পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন। ফলে আবার তিনি একক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। এবার তার ক্ষমতার নেপথ্য শক্তি ছিল ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু আবার সর্বময় সুলতান হয়ে উঠলেও এবার তার ক্ষমতা ছিল শুধুমাত্র ইস্তানবুল কেন্দ্রিক। তুরস্কের বাকি অংশ ছিল জাতীয়তাবাদীদের দখলে।

আতাতুর্কের জিহাদ

যখন জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন সুলতান, তখন পাল্টা ব্যবস্থা নেন মুস্তাফা কামাল, যিনি পরবর্তীতে আতাতুর্ক নামে পরিচিতি লাভ করেন।

তিনি তুরস্কের সব গভর্নর ও সামরিক বাহিনী কমান্ডারদের কাছে চিঠি পাঠান যেন গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে পাঠানো হয়। তিনি ইসলামিক বোর্ডের কাছে চিঠি লিখে জানান, তিনি সুলতানের জন্যই লড়াই করছেন, যিনি ইসলামের বর্তমান খলিফা। তিনি যৌথ বাহিনীর কাছ থেকে খলিফাকে উদ্ধার করে আনতে চান।

তিনি 'ধর্ম যুদ্ধে' নামার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

১৯২০ সালের ২৩শে এপ্রিল অ্যাসেম্বলির সভায় মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ককে স্পিকার ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হয়।

'ওসমান'স ড্রিম' বইয়ে ক্যারোলিন ফিঙ্কেল লিখেছেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে কয়েক দফা যুদ্ধের পর অবশেষে ১৯২২ সালের ১১ই অক্টোবর আর্মিসটিস অফ মুদানয়া স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে তুরস্কের স্বাধীনতা মেনে নেয়া হয়।

এরপরই গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সামনে সালতানাত বাতিলের প্রস্তাব তুলে ধরেন মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক। সেখানে বলা হয়, যেহেতু তিনি খলিফা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন, তাই খলিফার পদটি থাকবে, তবে কে খলিফা হবে, তা পার্লামেন্ট ঠিক করবে।

খিলাফতের বিলুপ্তি

পহেলা নভেম্বর অটোমান সালতানাত বিলুপ্তির পক্ষে ভোট দেয় তুরস্কের পার্লামেন্ট। এর ১৭ দিন পর সুলতান মেহমেদ একটি ব্রিটিশ জাহাজে করে মাল্টার উদ্দেশ্যে চলে যান। খলিফা হিসাবে তার স্থলাভিষিক্ত হন রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য ও সাবেক সুলতানের কাজিন আবদুলমেসিদ।

তবে আরও একবছর ইস্তানবুল যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। ট্রিটি অব লুসানের পর ১৯২৩ সালের দোসরা অক্টোবর যৌথ বাহিনী ইস্তানবুল ছেড়ে চলে যায়।

দুই বছর পরে অটোমান খেলাফতও বিলুপ্ত করা হয়। সেই সময় ওসমানী রাজপরিবারের প্রায় ১২০ জন সদস্যদের সবাইকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কার করা হয়।



মন্তব্য করুন