বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের আন্তঃসম্পর্ক

রোবায়েত ফেরদৌস
১২ মে ২০২২ ০২:৫৭ |আপডেট : ১২ মে ২০২২ ০৮:২০
রোবায়েত ফেরদৌস। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
রোবায়েত ফেরদৌস। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ভক্স পপুলাই ভক্স ডাই (জনগণের কণ্ঠস্বরই ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর)– লাতিন প্রবাদ

জ্যামিতির মতো গণতন্ত্রেরও সহজ সড়ক নেই; গণতন্ত্রের পথে কোনো রাষ্ট্রের পথচলা কখনোই একরৈখিক নয়, সবসময়ই তা আঁকাবাঁকা- দুস্তর আর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ; এ এক দীর্ঘ আর কষ্টকর ভ্রমণ- যার পথে পথে পাথর ছড়ানো। গণতন্ত্রের আত্মম্ভর আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, রাষ্ট্রকে দু পা সামনে তো এক পা পেছনে চলতে হয়। অগণতান্ত্রিক, প্রাচীন, সামন্ত বা সামরিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পেছনে মাড়িয়ে রাষ্ট্রকে আয়াসসাধ্য ভ্রমণে নামতে হয়- লক্ষ্য গণতন্ত্রে নোঙর গাড়া। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের উপস্থিতি, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, সাংবিধানিক চর্চার ধারাবাহিকতা, জবাবদিহিতা, চিন্তার বহুত্ববাদিতা- যা গণতন্ত্রের অন্যতম নিদান- একটি রাষ্ট্রে তার সঠিক চর্চা নিশ্চিত করা মোটেই সহজ কোনো বিষয় নয়। গণতন্ত্রেরই আরেক অনুষঙ্গ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বলা হয়, গণতন্ত্রেরে জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। কেন বলা হয়? গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক কোথায়? গণমাধ্যম কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, না গণতন্ত্রই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে? গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে অনুসরণ করে না নেতৃত্ব দেয়? আবার এ প্রশ্নও তো বেশ যুৎসই যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আসলে কী? কিংবা একটি রাষ্ট্র্র কতোটুকু গণতান্ত্রিক তাই-বা মাপা হবে কোন গজকাঠিতে?

কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশ ভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে; এতে আরেকটি প্যারাডক্স জন্ম নেয়- যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, যে সাংবাদিক সরকারের ভুলচুক নিয়ে নিয়ত রিপোর্ট করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা সেই সাংবাদিকের নিরাপত্তা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। অনেকটা সংসদে বিরোধী দলের অবস্থানের মতো, তারা সংসদে সরকারের কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা করবে, তারা যেন সংসদে তা সুষ্ঠুভাবে করতে পারে, সেই সুযোগ সরকারি দলকেই নিশ্চিত করতে হবে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি কিন্তু তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’- ভলতেয়ারের এই উক্তিই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌল চেতনা; এই চেতনা আর এর চর্চার ভেতরেই লুক্কায়িত থাকে গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা।   

তো গণতন্ত্রের পথচলায় গণমাধ্যম কী করতে পারে? গণমাধ্যম নাগরিকদের বহুমুখীন যোগাযোগের পাটাতনটি তৈরি করে দেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানে যেহেতু খোলা সমাজ, তাই মানুষকে এখানে বহু স্তরে বহু পর্যায়ে বহু ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করতে হয়। গণমাধ্যমে মানুষের জন্য তথ্যের বৃহত্তর প্রবেশগম্যতা তৈরি হয়। সরকারকে চোখে চোখে রাখার মধ্য দিয়ে ‘গণতন্ত্রের প্রহরী’র ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম পাবলিক ডিবেট উস্কে দেয়, পলিসি এজেন্ডা নির্ধারণ করে, নাগরিক মতামতের ফোরাম তৈরি করে- যেখানে জনগণ রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তাদের ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। দুর্নীতির ওপর সার্চ লাইট ফেলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাজে স্বচ্ছতা নির্মাণ করে। অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন- রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীন হলে এমনকি ঠেকিয়ে দেওয়া যায় দুর্ভিক্ষও।  অজ্ঞতা ও ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি না করে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞাত হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে- সচেতন ভোটাররা তখন  খারাপ শাসককে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিতে পারে। গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত পাবলিক স্ফেয়ার/জনপরিসর বাড়িয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে সেতু গড়ে। প্রতিদিনের রাজনৈতিক ইস্যু/বিতর্ক তুলে ধরে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি মনিটর করে। বহু স্বার্থ বহু কণ্ঠস্বর তুলে ধরে। সরকারে  কাজের রেকর্ড, তাদের মিশন-ভিশন, নেতাদের পারঙ্গমতা তুলে ধরে। শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণকে সম্ভব করে তোলে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, গেল ৫০ বছরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কেবল ক্রমাবনতি ঘটেছে। ২০২২ সালে বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) যে সূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম (স্কোর ৩৬ দশমিক ৬৩)। ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম ( স্কোর ৫০ দশমকি ২৯)। এর মানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে। এবারের সূচকে প্রতিবেশী মিয়ানমার ছাড়া সবার নিচে বাংলাদেশ। ভারত ১৫০তম, পাকিস্তান ১৫৭তম, শ্রীলঙ্কা ১৪৬তম, আফগানিস্তান ১৫৬তম, নেপাল ৭৬তম ও ভুটান ৩৩তম। ২০২২ সালে, আরএসএফ এর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে একজন সাংবাদিক নিহত এবং তিনজন কারাবন্দি আছে। কেন এই অধঃপতন? আমার প্রতীতি, এর পেছনে সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’। গত ২৬ মাসে এই আইনে প্রায় ৯০০ মামলা হয়েছে, তারমধ্যে অধিকাংশ মামলা কেবল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। মামলাগুলো অধিকাংশ করেছে সরকারি দল বা তাদের সমর্থকরা। এই আইনটি ব্যাপকভাবে সাংবাদিকদের দমন, পীড়ন, হেনস্তা ও গ্রেপ্তারে ব্যবহৃত হয়েছে। এই আইনটির অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার তার চূড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম করেছে। এর বাইরে রয়েছে সাংবাদিকদের চাকরিসহ নানাবিধ নিরাপত্তাহীনতার বোধ। আছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। রাজনৈতিক কারণে সব সরকারের আমলেই সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সরকারি দলের মদদপুষ্ট নেতা-কর্মীরা সংবাদমাধ্যমের প্রতি চড়াও হন। গণমাধ্যমের করপোরেট মালিকানাও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। মালিকদের কেউ কেউ নিজেদের প্রভাব বিস্তার, ব্যবসায়িক ফায়দা তোলা কিংবা এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য অনেক সময় গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেন। ফলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন সম্পাদকীয় অবস্থানকে তারা ‘থোড়াই কেয়ার’ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দায়িত্বহীন ব্যবহার, ভুল তথ্য আর গুজবের সীমাহীন চর্চাও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। সরকারি রাষ্ট্রযন্ত্র বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন ধরনের চাপ ও কৌশল ব্যবহার করেন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে। দেশে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে, যেখানে সাংবাদিক কেন নাগরিকরাও কোনো কিছু লিখতে বা বলতে বারংবার চিন্তা করেন। এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর চেহারাই যেন ফুটে ওঠে। সব মিলিয়ে আমি মনে করি, মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য সরকার, রাষ্ট্র ও সমাজকে যে দায়িত্ব পালন করতে হয়, বাংলাদেশে আন্তরিকভাবে তার চর্চা কখনোই আমরা হতে দেখিনি। জাতি হিসেবে আমাদের একটা বদভ্যাস হচ্ছে, বিদেশি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন যখন সরকার ও বিরোধী দলের পক্ষে যায়, তখন তারা তা সানন্দে গ্রহণ করে, তা নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করে। আর বিপক্ষে গেলে সরাসরি প্রত্যাখান করে কিংবা নয়া ষড়যন্ত্রতত্ত্বের উপাখ্যান বানায়। এই অবস্থান থেকে বের হয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। শতভাগ গ্রহণ কিংবা পুরোপুরি প্রত্যাখানের সংস্কৃতি আমাদেরকে আসলে কোথাও নিয়ে যাবে না। আমাদের যা করা উচিত তা হলো- আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে গুরুত্বসহকারে নেওয়া, সমস্যার কারণ চিহ্নিত করা এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করা। সরকারের উচিত এধরনের প্রতিবেদনকে প্রফেশনালি মোকাবিলা করা এবং আগামী বছরগুলোতে যাতে আমাদের সূচকের উন্নতি হয়, তার ব্যবস্থা করা। ভুলে গেলে ভুল হবে, উন্নয়ন কেবল পথঘাট বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, উন্নয়ন হতে হবে সার্বিক- যার মধ্যে মানুষের সাংস্কৃতিক রুচি, গুণগত শিক্ষার মান, প্রতিবেশ-পরিবেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা কিংবা পরমতসহিষ্ণুতার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত।

মনে রাখা দরকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা পরস্পরের পরিপূরক, বিপরীতমুখী নয়। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কোনো অবস্থায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। আবার সংবাদমাধ্যমকেও তার বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা বজায় রাখতে হবে। আমরা মনে করি, সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাকে বৈরী হিসেবে দেখা ঠিক নয়। গণতন্ত্রের বিকাশে ভিন্নমত পোষণের পূর্ণ সুযোগ থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ না ভেবে সাংসদেরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন- সেটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে। গণতন্ত্রের জন্য সমালোচনা সব সময় সহায়ক- সরকারের মনোজগতে এই সংস্কৃতিকে ঠাঁই দিতে হবে। তবে মনে রাখা দরকার, প্রেসের স্বাধীনতা মানে হাত-পা খুলে যা-খুশি রিপোর্ট করা নয়, প্রকাশিত রিপোর্টকে অবশ্যই সত্য, যথার্থ আর পক্ষপাতহীন হতে হবে। সততা, নির্ভুলতা আর স্বচ্ছতা হচ্ছে সাংবাদিকতার মৌল তিন নীতি- যার ওপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার চর্চাটি হয়ে থাকে। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জারি রাখার জন্য যেমন সদা সোচ্চার থাকতে হবে, তেমনি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পথে আমাদেরকে আরো অনেক দূর অবধি যেতে হবে; যেতে হবে গণতন্ত্রকে সতেজ টাটকা আর ফুরফুরে রাখার তাগিদে।



মন্তব্য করুন