বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভোজ্য তেল নিয়ে তেলেসমাতি কি চলতেই থাকবে?

চিররঞ্জন সরকার, কলামিস্ট
১৫ মে ২০২২ ০৪:০৭ |আপডেট : ১৫ মে ২০২২ ০৯:০৪
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

রসনা-বিলাসে অভ্যস্ত মানুষকে কম তেলে কিংবা বিনা তেলে রান্নার উপদেশ দিয়ে কোনো সুফল ফলবে না। যেটা করা যেতে পারে, তা হলো সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে সরিষার তেলের ব্যবহার বাড়ানো। সেটা হতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।

ভোজ্য তেলের সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নানা রকম নসিহত দিচ্ছেন। সব কিছুতে কেন তেল খেতে হবে, রান্নায় তেলের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া উচিত, তেলের বিকল্প ভাবতে হবে, তেল ছাড়া বা কম তেলে রান্নার অভ্যাস করতে হবে ইত্যাদি উপদেশমূলক বাক্য ঝাড়ছেন। যদিও এসব অবাস্তব ও অসার কথা বলে কোনো লাভ নেই। রসনা-বিলাসে অভ্যস্ত মানুষকে কম তেলে কিংবা বিনা তেলে রান্নার উপদেশ দিয়ে কোনো সুফল ফলবে না। যেটা করা যেতে পারে, তা হলো সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে সরিষার তেলের ব্যবহার বাড়ানো। সেটা হতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এজন্য সরিষার উৎপাদন বাড়াতে হবে। সরিষার তেল উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারের ব্যাপারে উৎসাহ ও প্রণোদনা দিতে হবে। সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ভোজ্য তেলের সংকট দূর করতে হলে এখন থেকেই পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। আপাতত যা করা উচিত সেটা হলো যেকোনো মূল্যে তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখা। নানা কারসাজি করে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের তেলের দাম বাড়ানোর সব রকম অপতৎপরতা রুখে দেওয়া। কিন্তু এই কাজটি সরকার কখনও যথাযথভাবে করছে না বা করতে পারছে না। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার নেশাকে সরকার কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

এদিকে তেলের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের অনেক জায়গায় বাড়তি দামেও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার থেকে তেল উধাও। না, তেল এমনি এমনি উধাও হয়নি। কারসাজি করে তেল বাজার থেকে উধাও করে দেওয়া হয়েছে। খোলা বা বোতলজাত তেল পাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে। পাওয়া গেলেও সাধারণ ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশিতে। অথচ এমন নয় যে, সয়াবিন তেলের সরবরাহ নেই। আছে, তবে দোকানে নয়, গুদামে। তথ্য বলছে, এপ্রিল মাসের ১ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত ৬টি কোম্পানি আট কোটি লিটার সয়াবিন তেল বাজারজাত করেছে। তারপরও বাজারে তেল নেই! কারণ কী? কারণ লাভ আর মুনাফার নেশা। বর্তমানে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। বাজার তদারকির অভাবের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ বিপুল পরিমাণে সয়াবিন তেল মজুদ করে রেখেছে। টাকা বানানোর খেলায় একটা বিশেষ সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার মচ্ছবে সিন্ডিকেটের কেউই পিছিয়ে নেই। আমদানিকারক, মিল মালিক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতার সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে তৎপর।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়েছে প্রশাসন। বিভিন্ন স্থানে চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। গত কয়েকদিনে দেশের ৭ জেলায় অভিযান চালিয়ে মজুদ করে রাখা ১ লাখ ৬৫ হাজার লিটার ভোজ্যতেল জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৯২ হাজার লিটার, কুষ্টিয়ায় ৪০ হাজার লিটার, পাবনায় ১৮ হাজার লিটার, সিলেট ৫ হাজার লিটার, গাজীপুরে ২ হাজার ৫৮ লিটার, সিরাজগঞ্জে ৬ হাজার লিটার এবং রংপুরে ৩শ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। একইসঙ্গে মজুতদারির দায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। অন্যদিকে সয়াবিনের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার যে পদক্ষেপ বন্ধের দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। গত ১১ মে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর ডাকে ভোজ্য তেল নিয়ে এক মতবিনিয়ম সভায় এসে তারা এই দাবি তোলেন।

বর্তমান তেল সংকটের জন্য কেউ আঙুল তুলছেন আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানির দিকে, কেউ পাইকারের দিকে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা আগে থেকেই টাকা দিয়ে রাখলেও তেল সরবরাহ পায় না। আবার অনেকে ভোজ্যতেলের সঙ্গে অপ্রচলিত পণ্য কিনতে বাধ্য করার বিষয়টিকে সামনে আনছেন। কিন্তু এর কোনোটি নিয়েই ধারাবাহিক প্রশাসনিক তদারকি নেই। 

তেল নিয়ে কারসাজি চলছে মার্চ মাসের শুরু থেকেই। তেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেট সে সময় সংকট সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দেখিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। পুরো রমজান মাস জুড়েই ছিল তেলের বাজার অস্থিতিশীল।

ঈদের আগের দিন দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল না পাওয়া গেলেও অভিযানে তেল পাওয়া গেল ডিলার ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের গুদামে। ‘চোর-পুলিশ খেলা চলল। এইভাবে পার হলো ঈদ। ঈদের পর থলের বিড়াল বেরিয়ে এলো। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী আর মজুতদাররা জানত ঈদের পর আনুষ্ঠানিকভাবে দাম বাড়ানো হবে। অতএব গুদামজাত করতে পারলে লাভ আর লাভ। এক মাসে যা হয় হোক। জরিমানা, জেল এসব আর এমন কি!

ঈদের দিন পার হতেই খবর এলো বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটারে বাড়ছে ৩৮ টাকা, খোলা তেলের দাম বেড়েছে প্রতি লিটারে ৪৪ টাকা। এখন ব্যবসায়ী আর সরকার মিলে নির্ধারিত দামই প্রতি লিটার ১৯৮ টাকা।

বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমদানি পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। সরকার যদি সয়াবিন তেল আমদানি ‘ওপেন করে দিতো তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা আমদানিকারক, তারা তাদের নির্দিষ্ট ডিলারদের দিয়ে সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুদ করে এই সংকট তৈরি করছে। অথচ তারা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে তেলের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। একথা ঠিক যে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে। বাজারের হিসাবই বলছে, গত বছরের মে মাসে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৫৬৮ দশমিক ৬৫ ডলার। আর গত ১০ মে পর্যন্ত প্রতি টন সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯২১ দশমিক ৯৯ ডলারে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের মে মাসে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ছিল ১১৮ থেকে ১২২ টাকা। আর গত ১০ মে এই তেলের দাম উঠেছে ১৮২ থেকে ১৯২ টাকা পর্যন্ত। খোদ সরকারি সংস্থার হিসাবে এ সময়ে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৫৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

গত ৬ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের তৈরি প্রতিবেদনে এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম ৩৫ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। তাও যদি ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও নতুন যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বিশ্ববাজারের তুলনায় বেশি। অথচ এ সময়ে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের বিভিন্ন স্তরে শুল্ক-কর বাবদ প্রায় ৩০ শতাংশের মতো রেয়াত পেয়েছেন।

এদিকে আমাদের মহামহিম বাণিজ্যমন্ত্রী ভোজ্যতেলের সংকটের জন্য ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন। তিনি ভোক্তাদেরও দুষছেন। ভোক্তারা হুজুগ ও গুজবে পড়ে বেশি বেশি তেল কিনে বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

মাসাধিককাল ধরে এমন দোষারোপের খেলাই চলছে। কিন্তু তেলের দাম তাতে কমছে না, তেল সংকটও ঘুচছে না। প্রশ্ন হলো, তেল নিয়ে এই তেলেসমাতি কি চলতেই থাকবে? আর কত মুনাফা হলে টার্গেট পূরণ হবে? অন্য কোনো পণ্যের ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই তাদের পালার জন্য অপেক্ষা করে আছেন! দেশে এভাবেই সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, তাদের পকেট কেটে এক শ্রেণির লোভী মানুষ টাকার কুমিরে পরিণত হচ্ছে। তারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করছে। দেশের বাইরে একের পর এক ‘বেগমপাড়া গড়ে উঠছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি আর অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের সাফল্যের গল্পে আমাদের যতই বিভোর রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, এই দেশের চৌষট্টি শতাংশেরও বেশি এমপি যে ব্যবসায়ী সে কথা ভুলে যাব কীভাবে? এর আগে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ‘টাকা লোপাটকারীদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি টাকা লোপাটকারীদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সামর্থ্য ও ইচ্ছে কোনো কর্মকর্তা কিংবা ক্ষমতাসীন মহলের কারো আছে? তাহলে তেল মজুদকারীদের এত অল্পতেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? গুদামে, সুড়ঙ্গে, মাটির নিচে যারা ভোজ্য তেল মজুদ করে রেখেছে, সেই সব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মজুদদারি আইনে বিচার হচ্ছে না কেন? মাত্র কয়েক হাজার টাকা জরিমানাই কি এর উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে, না হওয়া উচিত?

সরকার শুধু ব্যবসায়ীবান্ধব হবে, নাকি ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষের অর্থাৎ জনবান্ধব হবে, সেই সিদ্ধান্ত দ্রুতই গ্রহণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আবেদন-নিবেদন, মামুলি জরিমানায় কাজ হবে না। প্রয়োজনে পিঠে লাঠির বাড়ি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেমন প্রাণী, মুগুরও তেমনি হওয়া চাই।



মন্তব্য করুন