সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ আর পুষ্টিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ

ইসরাত জাহান তানজু
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:১৬ |আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২২ ১৫:১৯
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার পর থেক বাংলাদেশ খাদ্যে কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও পুষ্টির দিক থেকে একদমই পিছিয়ে রয়েছে। জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্যের দিকে নজর দিতে পারেনি সরকার। আসলে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বিষয়টি কোনো একক বিষয় নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক বিষয়।

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জনগণের জন্য পুষ্টির কথা বললেই হবে না, পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য এবং শারীরিক, মানসিক ও কর্মদক্ষতা উন্নয়নে পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায়ও পুষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতি ইঞ্চিকে ফসলি জমি হিসেবে পরিণত করতে হবে। সামান্য জায়গাও যেন পতিত না থাকে। এর উদ্দেশ্য হলো কেউ যেন অনাহারে না থাকে। যেন তাদের পুষ্টির অভাব না হয়।করোনায় দেশের ১৬ শতাংশের বেশি মানুষ বেকার হয়ে পড়ায় বিশেষ করে শহরমুখী মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।অভাবের তাড়নায় মানুষ খাদ্য যোগাড় করতে গিয়ে পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্ব দিতে পারছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে, খাদ্যশক্তি গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ গত ২০ বছরে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ২ হাজার ২৮৫ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি গ্রহণ করত। আর এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫১৪। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান বাংলাদেশের চেয়ে খাদ্যশক্তি গ্রহণে এগিয়ে আছে। এর বৈশ্বিক ক্ষুধা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন-২০১৯ বলছে, বাংলাদেশের তীব্র ও মাঝারি ধরনের ক্ষুধায় থাকা মানুষের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে। তীব্র ক্ষুধা বলতে যারা এক বেলার বেশি খাবার পায় না। আর মাঝারি বলতে বোঝায় যারা দুই বেলার বেশি খাবার পায় না।

২০১৭ সালে তীব্র ক্ষুধায় থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ। ২০১৮ সালে তা ১০ লাখ কমেছে। তবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে চার লাখ। আগের তুলনায় দেশে গড়ে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অন্য এক পরিসংখ্যান মতে- এখনো দেশের অর্ধেক গর্ভবতী নারী রক্তশূন্যতায় ভোগেন। মানুষের দৈনিক খাদ্যশক্তি গ্রহণের পরিমাণ বৈশ্বিক ন্যূনতম মানে পৌঁছাতে পারেনি।

অন্যদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেক বেড়েছে। এ সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় ভেজাল খাদ্য বিক্রি করছে। এতে জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন বিপন্ন হচ্ছে। জনকল্যাণের স্বার্থে তাই ভেজাল খাদ্য উৎপাদন, বিক্রি ও পরিবেশন প্রতিরোধ করা দরকার। এই ভেজাল দেয়া হচ্ছে নানাভাবে। এক খাদ্যের সঙ্গে অন্য খাদ্য মিশিয়ে, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করে, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার করে, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য রং প্রয়োগ ইত্যাদি উপায় খাদ্যে ভেজাল দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে ভেজাল খাবারের অবস্থা খুবই মারাত্মক।

এক শ্রেণির অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী খাদ্যসংরক্ষণ ও তাড়াতাড়ি পাকানো বা ক্রেতাকে আকর্ষণ করার জন্য পণ্যে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী কেমিক্যাল ও বিষাক্ত রং ব্যবহার করে খাদ্যে ভেজাল সৃষ্টি করছে। ভেজাল খাদ্য খেয়ে জনসাধারণ আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদি পেটের পীড়ায় ভুগছে। যারা ভেজাল খাদ্য খাচ্ছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ দুর্বল ও কৃশ হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের স্মরণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। তা ছাড়া ভেজাল খাদ্য খেয়ে অনেকেরই ওজন অত্যধিক কম বা বেশি হয়ে যাচ্ছে। কারো কারো চুল অকালে পড়ে যাচ্ছে কিংবা সাদা হয়ে পড়ছে। অনেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছে, আবার অনেকেই অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করছে। এসব ছাড়াও ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, কর্মক্ষমতা হ্রাস, কিডনির সমস্যাসহ নানা রকম রোগ দেখা যায়।স্কুলের গেটের সামনে বাচ্চাদের কাছে মুখরোচক ভেজাল খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। এ খাবার খেয়ে বাচ্চারা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে।

পুষ্টিমান কম। ২০১৭ সালের হিসাবে মোট খাদ্যশক্তির ৮০ শতাংশ দানাদার জাতীয় খাদ্য থেকেই আসে। শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষ প্রতিদিন যে খাবার খায়, তার মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার থাকে অর্ধেক। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের দুধ ও মাংস খাওয়ার পরিমাণের দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম ১০০টি দেশের মধ্যে নেই। ফিনল্যান্ডের মানুষ প্রতিদিন ৩৬১ মিলিলিটার ও সুইডেনে ৩৫৫ মিলিলিটার দুধ খায়। সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় দিনে মাত্র ৩৩ দশমিক ৭ মিলিলিটার। মাংস খাওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩টি দেশের মধ্যে ১৭২ তম। সবচেয়ে নিচে আছে ভারত, এই দেশটির বেশির ভাগ মানুষ ধর্মীয় কারণে গরুর মাংস খায় না। হংকংয়ের মানুষ যেখানে প্রতিদিন ৪১৯ দশমিক ৬ গ্রাম ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩১৮ দশমিক ৫ গ্রাম করে মাংস খায়। সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় ১১ দশমিক ২৬ গ্রাম।

রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও যান্ত্রিক সেচের প্রসার প্রাথমিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করলেও এর বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে; এখানকার প্রাণপ্রকৃতির সঙ্গে মানানসই অনেক খাদ্য ও মৎস্য উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটেছে। ভূগর্ভস্থ পানি নির্বিচারে ক্রমাগত টেনে তোলায় ভূগর্ভে ভারসাম্য অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর এক মহাবিপর্যয়কারী ফল হলো আর্সেনিক। বহু বছর যে টিউবওয়েলকে নিরাপদ পানির উপায় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, এবং দাবি করা হয়েছে বাংলাদেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষ নিরাপদ পানি পান করছে, সেই টিউবওয়েলগুলোর একটি বড় অংশ এখন আর্সেনিকযুক্ত পানির প্রবাহের মাধ্যম। বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন আর্সেনিক বিষের হুমকির মুখে।


বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্যনীতি এই সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়নি। কেননা, এসব নীতি প্রণয়নে বহুজাতিক পুঁজির যত প্রভাব, তার একাংশও কৃষক বা সর্বজনের নেই।বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন এখন প্রায় পুরোপুরি রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও যান্ত্রিক সেচনির্ভর। ধান, ফল, সবজি, মাছ, ডিম, মুরগিসবকিছুরই উৎপাদন বেড়েছে, আকর্ষণীয় চেহারায় সেগুলো বাজারে উপস্থিত হচ্ছে। কিন্তু এর প্রায় সবই নানা মাত্রায় বিষ বহনকারী। নকল, বিষাক্ত রং ও ভেজাল কারখানা এখন বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্র। গ্রামের হাটবাজার এসব বিষের মোহনীয় বিজ্ঞাপনে ভরা। খাবারের জৌলুশ বাড়ছে, বিশ্বজোড়া মুনাফা ও বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে। জিডিপি বাড়ছে। অন্যদিকে, খাদ্যনিরাপত্তার মৌলিক শর্ত নিরাপদ খাদ্য বিপন্ন, নতুন নতুন হুমকির মুখে অরক্ষিত মানুষ। এসবের মধ্য দিয়ে মানুষের বিশুদ্ধ পানির অধিকার সংকুচিত হচ্ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে বোতল পানির বাণিজ্য। কোমল পানীয়সহ নানা ধরনের ক্ষতিকর ‘শক্তিবর্ধক পানীয়তে বাজার সয়লাব। ভারতে একদল বিজ্ঞানী কোমল পানীয়তে বিষাক্ত উপাদান আবিষ্কার করার পর কোথাও কোথাও তার বিক্রি কমলেও বিজ্ঞাপনের জোরে সেগুলোর প্রতাপ এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে।

তাই জনগণের খাদ্য, পুষ্টি ও বৈচিত্র্যময় চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা এবং তা সকলের কাছে সুলভ করা। কিন্তু কৃষি ও খাদ্যের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিকীকরণ ও মুনাফামুখী তৎপরতা একদিকে উৎপাদনক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে, অন্যদিকে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে দীর্ঘ মেয়াদে তা সুষম খাদ্য উৎপাদন অনিশ্চিত ও নাজুক করে তুলেছে। পাশাপাশি বিনা বিচারে গোষ্ঠীস্বার্থে ‘উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কৃষিজমি, মাটির ওপরের ও নিচের পানিসম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়ছে।কিন্তু বর্তমান ‘উন্নয়ননীতি এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে অক্ষম ও অনিচ্ছুক।



মন্তব্য করুন