শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা এবং প্রাসঙ্গিক কথা

অলোক আচার্য
৯ নভেম্বর ২০২০ ০২:৩৩ |আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২১ ০১:৪৩
অলোক আচার্য, লেখক-সাংবাদিক
অলোক আচার্য, লেখক-সাংবাদিক

যদি অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় তাহলে গুচ্ছ পদ্ধতিই হবে সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। যেখানে শিক্ষার্থীর শ্রম,অর্থ এবং ভোগান্তি সবকিছুই শিক্ষার্থীর জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং অবশ্যই একটি মাইলফলক হবে।

করোনা মহামারির কারণে এ বছর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থা। থমকে গেছে পরীক্ষা, ক্লাসসহ সব কার্যক্রম। পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অটোপাসের সিদ্ধান্ত, মাধ্যমিকে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মোট কথা পরীক্ষা নেওয়ার অবস্থায় আমরা নেই। শিক্ষার কার্যক্রম কবে স্বাভাবিক গতিতে শুরু করা সম্ভব হবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। এখন এইচএসসিতে অটোপাসের পর আলোচনায় রয়েছে ভর্তি পরীক্ষা। কোন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

বিগত কয়েক বছর ধরেই আলোচনায় রয়েছে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি, যা সার্বিকভাবেই শিক্ষার্থী এবং তার পরিবারের জন্য মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু গত কয়েক বছরেও তা পুরোপুরিভাবে কার্যকর করা যায়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পরীক্ষার্থীদের ছুটতে হয়। এখন করোনার কারণে এমনিতেই নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের কথাই চিন্তা করতে হবে সবার আগে। যদিও ইতিমধ্যেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বশরীরে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যদি অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় তাহলে গুচ্ছ পদ্ধতিই হবে সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। যেখানে শিক্ষার্থীর শ্রম,অর্থ এবং ভোগান্তি সবকিছুই শিক্ষার্থীর জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং অবশ্যই একটি মাইলফলক হবে।

সাতটি কৃষিপ্রধান বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি, ১১টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি, তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি এবং নয়টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছে পরীক্ষার প্রস্তাব রয়েছে। তবে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। গত কয়েক বছর ধরেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষা নিচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে তারা বহু ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে বিগত কয়েক বছর যাবৎ আলোচনা হলেও কার্যক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঘটানো যায়নি।

চলতি বছরেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়েই আলোচনা চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে কি না তা ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না। কারণ আগের বছরেও তো শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ধারণাটি আসলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে এবং আরও আনুষঙ্গিক কয়েকটি কারণে নেওয়া হয়েছিল। একজন শিক্ষার্থী এবং তার অভিভাবক দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রায় সময়ই নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে একই শিক্ষার্থীর একই তারিখে একাধিক পরীক্ষা থাকে। সেক্ষেত্রে তাকে একটি পছন্দ করতে হয়। তাছাড়া  যদি পরপর দুই দিনও পরীক্ষা থাকে সেক্ষেত্রে যাতায়াত পথ দীর্ঘ হলে পরীক্ষার্থী ক্লান্ত হয়ে যায়। এতে তার পরীক্ষার ওপরও প্রভাব ফেলে। ইতিপূর্বে যানজট অনেক ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। এসব কারণে জোর দাবি ছিল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার। মেডিক্যাল কলেজগুলো সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে।

প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই সময়টা কাটে ছাত্রছাত্রীদের টেনশনের ভেতর। কোথাও ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তার মধ্যে এই দুঃশ্চিন্তা কাজ করে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া,সেখানে থাকার চিন্তা সবমিলিয়ে বেশ সংগ্রাম করতে হয় এসময়। জীবন যুদ্ধে থেকে কোন অংশে কম না এই ভর্তি যুদ্ধ। প্রতি বছর যে হারে পাসকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সংখ্যা তার থেকে কম। তারপর আবার রয়েছে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়,পছন্দের বিষয় নির্বাচন। সব মিলিয়ে বিশাল চাপ। উচ্চ শিক্ষার জন্য তাই তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। এই তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তারা নিজেদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়।

কিন্তু তারা এই প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়। এইচএসসি পাসের পরই তারা পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে প্রথমেই মোটা টাকা দিয়ে কোচিংয়ে ভর্তি হয়। তারপর মাস দুয়েক ভর্তি কোচিং শেষ করে ভর্তি পরীক্ষায় অবর্তীণ হয়। এই সময়ে যাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল তারা এই কোচিং করার সুযোগ পায় না। প্রচলিত ধারণা এটাই যে কোচিং ছাড়া কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায় না। অবশ্য প্রচলিত ধারণাই আজ ধ্রুব সত্যি। অভিভাবকদের মধ্যে তাই নামী দামী কোচিংয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিশেষ কোনো বই বা কোচিংয়ের প্রচার চলে- তখন তা সম্ভব হবে না। ভর্তি পরীক্ষা হবে সমন্বিতভাবে। মেধা অনুযায়ী শিক্ষার্থী কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে।

কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর আবার শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তোলার পালা। আলাদা আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আলাদা আলাদা ফরম তুলতে হয়। ফর্ম কেনার সাধ্যও অনেক পরিবারের থাকে না। সেখানেও গরীব মেধাবীরা পিছিয়ে পড়ে। একজন সামর্থ্যবান শিক্ষার্থী প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলে ফেলে। কিন্তু তাতে তার হাজার হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। দেখা যায় এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে শুরু করে কেবল ফর্ম তোলা পর্যন্তই মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়। যার সাধ্য অনেকের থাকে না।

দেশের একেক প্রান্তে এক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। দেখা যায় আজ ঢাকায় তো আগামীকাল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা। ফলে ঢাকার পরীক্ষা শেষ করে ছুটতে হয় গাড়ি ধরতে। বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকুও থাকে না। তারপরদিন হয়তো পরীক্ষা থাকে দেশের অন্য কোনো প্রান্তে। এভাবে ছুটতে গিয়ে যাদের গাড়ি যানজটে আটকে যায় তারা আটকে থাকে। তাদের জন্য আমাদের তেমন কিছু করার নেই। অথচ তাদের বিন্দুমাত্র দোষ নেই। যেকোনো পদ্ধতি প্রয়োগে সমস্যা আসতে পারে, তবে তা সমাধান করেতে আলোচনা করতে হবে। আমরা কেবল ভর্তি পরীক্ষার্থীদের ঝামেলা লাঘব করতে চাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে একমত হওয়া প্রয়োজন। সময়ের দাবি এটাই। তাদের শারীরিক ও মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে হবে।

মেডিকেল কলেজগুলোতে এই পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা প্রচলিত আছে। যদি এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হতো তাহলে কোনো পরীক্ষার্থী সিলেট বা যশোর যে কোনো এক স্থান থেকেই অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা দিতে পারতো। সেক্ষেত্রে মেধা তালিকাও আবেদনের বিশ্ববিদ্যালয় অনুযায়ী করা হবে। যদিও কয়েক বছর ধরেই কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক মত থাকলেও আমাদের বিরাট এই কর্মযজ্ঞ যে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে আয়োজন করা হয়, তাদের স্বার্থকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে। যানজট যদি নাও সমস্যা করে তাহলেও দীর্ঘ পথের ক্লান্তি থেকে তাদের মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। অপরিচিত স্থান, আবাসন অনিশ্চয়তা, যাত্রার যানবাহন সমস্যা ইত্যাদি থেকে মুক্তি দিতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আশা করি আমরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মতো একটি মহৎ কর্মযজ্ঞ দেখতে পারবো।



মন্তব্য করুন