শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘বাবুই পাখি’ আজ মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার

শাহরিয়ার নাসের
১৬ এপ্রিল ২০২১ ১৪:৫৫ |আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৩২
শাহরিয়ার নাসের
শাহরিয়ার নাসের

রজনীকান্ত সেনের কবিতা ‘স্বাধীনতার সুখ’ ছোটবেলায় বহুবার পড়েছি। একদম ঠোঁটের ডগায় ছিল বিখ্যাত এ কবিতা। কবিতার চরণগুলো আজও ভীষণভাবে ভাবায় আমাকে। স্বাধীনতার মাঝে যে চিরসুখ নিহিত ঠিক সেটিই ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তার কবিতায়। অন্যের তৈরি অট্টালিকায় থাকার চেয়ে নিজের তৈরি ছোট্ট কুঁড়েঘরে রোদ-বৃষ্টি আর ঝড় ভেদ করে থাকার মাঝেই প্রকৃত সুখের দেখা মেলে, থাকে পূর্ণ স্বাধীনতা। ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতা যেন তাই বলে।

আমার গাঁয়ের বাড়ির ধারে অনেকগুলো তালগাছ ছিল। ছোটবেলায় দেখতাম কত চমকপ্রদ করে তালগাছে বাবুই পাখি বাসা বাঁধছে। এ যেন অট্টালিকার চেয়েও মজবুত শিল্প। বিকেল বেলায় হাঁটতাম আর বাবুইয়ের বাসা বাঁধার দৃশ্য তালগাছের পানে তাকিয়ে দেখতাম। শুনতাম বাবুইয়ের ডাক। মাঝেমধ্যে রজনীকান্তের কবিতার চরণ আবৃত্তি করতাম আর চিন্তা করতাম ওরা কত স্বাধীন। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাবুই নিজের ছোট্ট কুঁড়েঘরে খোঁজে পায় অসীম স্বাধীনতার সুখ। রজনীকান্তের সেই স্বাধীন বাবুইয়ের সুখ অনেকের কাছে আজ হিংসার কারণ। বাবুইয়ের স্বাধীনতাটুকু আজ খর্ব করছে কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষরূপী কিছু অমানুষ। প্রকৃতির স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের কারিগর বাবুইকে চিরতরে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় আজ তারা লিপ্ত। মানুষের চরম নিষ্ঠুরতায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি।

 

এ সপ্তাহে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাবুই পাখির প্রতি চরম অমানবিকতার নিদর্শনের সংবাদ দেখে কিছু না লিখে পারছি না। জাতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জেনেছি, পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে ক্ষেতের বোরো ধান খাওয়ার অপরাধে প্রায় দেড় শতাধিক বাবুই পাখির ছানা হত্যা করা হয়েছে। ৩-৪ জন মিলে বাবুই পাখির বাসাগুলো ভেঙেছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় উপজেলার সদর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে গত শুক্রবার ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ভৈরবপাশা ইউনিয়নে ক্ষেতের ধান খাওয়ায় অর্ধশতাধিক বাবুই পাখি পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বাবুইয়ের অপরাধ একটাই বাবুই ধান খেয়েছে। শুধু এই অপরাধে এভাবে জীব হত্যা কতটা কাম্য আমার জানা নেই। তবে সৃষ্টিকর্তা যে এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছে, শস্য দান করেছেন এসবের অংশীদার বাবুই পাখিও।

 

আমাদের এই প্রকৃতি, আমাদের এই জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। জীববৈচিত্র্য আমাদের মাঝে এনে দিয়েছে সমৃদ্ধি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা বলে হয়েছে। ইসলাম ধর্মের পাঁচ ভিত্তির অন্যতম হলো- নামাজ। এই নামাজের পর শ্রেষ্ঠ ইবাদত সৃষ্টির সেবা। নামাজ ফরজ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৃষ্টির সেবা নামাজের থেকেও অধিক গুরুত্ব লাভ করে। যেমন নামাজরত ব্যক্তি যদি জানতে পারে যে, কাছেই একজন মানুষ বা একটি প্রাণী বিপদে পড়েছে, তার জীবন সঙ্কটাপন্ন, দেরি হলে তার মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে, কিংবা অঙ্গহানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে নামাজ ছেড়ে দিয়ে ওই ব্যক্তি কিংবা প্রাণীটিকে বিপদমুক্ত কারার বা ক্ষতি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। পরে ফিরে এসে নামাজ শেষ করতে হবে। একদিন এক বালক পাখির বাসা থেকে দুটি ছানা নিয়ে যাচ্ছিল। মা পাখিটা ছানার শোকে পাগলপ্রায় হয়ে ওই বালকটির মাথার উপর উড়াউড়ি করতে লাগল। এই দৃশ্য দেখে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বালকটিকে বললেন, ছানা দুটি বাসায় রেখে এসো। দেখছ না মা পাখিটি কেমন পাগল হয়ে তোমার মাথার ওপর উড়াউড়ি করছে, নিজের জীবনের মায়া পর্যন্ত নেই।


রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথায় ওই বালক ছানা দুটিকে পাখির বাসায় রেখে এলো। ছানা দুটিকে পেয়ে মা পাখিটি বাচ্চা দুটিকে অনেক আদর-সোহাগ করল, তা দেখে রাসূলুল্লাহ (সা.) খুব খশি হলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা গৃহপালিত পশুর প্রতি খুব যত্নশীল হবে। তাদের ঠিকমতো খেতে দেবে। তারা যাতে কষ্ট না পায় এমন থাকার ব্যবস্থা করবে। তারা যা বহন করতে পারে তার অতিরিক্ত কিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। নবী (সা.) গর্তস্থ কীটপতঙ্গদের জীবন রক্ষার নিমিত্তে গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। কারণ গর্তে পিঁপড়া ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ থাকে। তারা মারা যেতে পারে, কষ্ট পেতে পারে। পশু-পাখির প্রতি এমন দয়া-মায়ার পরিপ্রেক্ষিতেই নবী (সা.)-কে শুধু মানুষের নবী না বলে রাহমাতুল্লিল আলামিন (বিশ্ববাসীর জন্য রহমত) অভিধায় ভূষিত করা হয়।

 

জীব সেবার কথা বলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। তার অমৃত বাণী জীবপ্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর আজও  আমাদের জীবের প্রতি মায়া তৈরি করে। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, জীব হত্যা মহাপাপ। তার এ বাণীটিও আমাদের কাছে অনুসরণীয়।

 

পশুপাখিরা যদি মানুষের মতো কথা বলতে পারতো, তাহলে তারাও তাদের কষ্ট, নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা দিতো। আজ  জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। পরিবেশের ভারসাম্য নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। একের পর এক দুর্যোগ। এসব জেনেশুনেও নির্মমভাবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বন্যপ্রাণী, সামুদ্রিক প্রাণী হত্যা করছে মানুষ।


এদিকে করোনায় চারদিকে ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল। বিশ্বের এই দুর্যোগময় সময়েও আমরা একের পর এক অমানবিক কাজ করছি। আমরা করোনাভাইরাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না। করোনাভাইরাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের মানবিক হওয়াটা এখন বেশি জরুরি। অমানবিক মানুষে নয়; পৃথিবীটা মানবিক মানুষে ভরে যাক। তাহলেই বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠবে পৃথিবী।

 

লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক



মন্তব্য করুন