শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবং আমাদের দায়

অলোক আচার্য
২৭ এপ্রিল ২০২১ ০০:৪৬ |আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২১ ১৬:২৩
অলোক আচার্য, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
অলোক আচার্য, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই দুর্ঘটনার কারণ এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপের সুপারিশও করা হয়। কিন্তু সেই একইভাবে যখন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন প্রকৃতপক্ষে কিছু বলার থাকে না। কেন সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগে? কেন মানুষের জীবন ও সম্পদ বারবার ঝুঁকিতে পরে? এসব প্রশ্ন জমা হয় কিন্তু সমাধান মেলে না। এরই ফাঁকে ফের দুর্ঘটনা ঘটে। তখন এই নিয়ে হৈ-চৈ হয়। বিভিন্ন দাবি ওঠে। তারপর যেন আবার আগের অবস্থা!

গত ১১ বছরে কেমিক্যাল গোডাউনগুলোতে তিনটি বড় অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১৯৮ জন মানুষ। যার মধ্যে ২০১০ সালে নিমতলীতে মারা গেছে ১২৪ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৭০ জন এবং মাত্র কয়েকদিন আগে (২৩ এপ্রিল) আরমাটিনটলার হাজী মুসা ম্যানশনে অগ্নিকান্ডে ৪ জন নিহত হয়েছেন। প্রতিটি ঘটনার পরেই রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়ার দাবি ওঠে। এই রাসায়নিক গুদাম যে খুব ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে গেল বছর লেবাননের বৈরুতের বিস্ফোরণে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আজ থেকে বছর দুই আগে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে দেশবাসী যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর তখন পুরান ঢাকার চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুরো জাতি হতবিহবল, স্তম্ভিত। সবার চোখ ছিল টিভি পর্দায়। একের পর এক মৃহদেহ, পোড়া, আধপোড়া। কত মানুষের স্বপ্ন নিমেষেই ছাই হয়ে গেল। নিমতলীর পর চকবাজার। দুই এলাকার দূরত্বও বেশি নয়। পরে জানা গিয়েছিল সেই আগুনের সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে। আর আগুন দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করেছিল কেমিক্যালের কারণে। নিমতলীতেও ভয়াবহ আগুনের পেছনে এই কেমিক্যাল ছিল। খুব দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পরে এই পদার্থের মাধ্যমে।

ফলে এসব কেমিক্যাল একটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ঘিঞ্জিপূর্ণ এলাকার মানুষের জীবন নিরাপদ করা আমাদের দায়িত্ব ছিল। আমাদের দেশে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ডে বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়। নিমতলীর এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন মারা যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি সেখান থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোসহ ১৭ টি সুপারিশ করেছিল। তারপর বহু বছর পার হয়ে গেছে। সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কমই। রাসায়নিক গুদাম যেভাবে ছিল সেভাবেই রয়ে গেছে। তারপর আবার এই চকবাজার ট্রাজেডি। তদন্ত হয় এবং তদন্তে  সেই সুপারিশ ও তা বাস্তবায়নের কথা ঘুরেফিরেই আসছে। কারণ সুপারিশ যদি বাস্তবায়িত না হয় তাহলে সেই সুপারিশে মানুষের লাভ কোথায়।

জনগণের জীবন নিয়ে যারা ছেলেখেলা করে তাদের বিরুদ্ধে জোরদার পদক্ষেপ কেন নেয়া হয় না। দুর্ঘটনা ঘটার পর অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার চেয়ে আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যাবস্থা নিলে সেই দিনটাই হয়তো আর দেখতে হয় না। গাড়িতে মেয়ায় উত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বহনের পাশাপাশি বাড়িতেও কিন্তু এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বহু অগ্নিাকান্ডের ঘটনা এবং তার ফলশ্রুতিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধেও ব্যাবস্থা গ্রহণ করা যায়। আমাদের চোখের সামনেই যেকোন দোকানে গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি করতে দেখা যায়। অথচ আইন অনুযায়ী এই গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির জন্য অনুমতির প্রয়োজন এবং সব ধরনের দোকানে বা যত্রতত্র বিক্রি করা যায় না। আবার এই সিলিন্ডারগুলোর মেয়াদ কতটা সতকর্তার সাথে নির্ণয় করা হয় তাই বা কতজন ব্যাবহারকারী জানে। পুরান ঢাকার অগ্নিকান্ডের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো একটি রাসায়নিক পল্লীতে এসব কেমিক্যাল স্থানান্তরের কাজ আর কত দীর্ঘ হবে? অথচ এরকম একটা ঘিঞ্জি স্থানে কেমিক্যাল ব্যবসা ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যাবে যতদিন এখানে এইসব দাহ্য পদার্থ থাকবে। নিমতলীর মত একটি ভয়াবহ ট্রাজেডি ঘটার পর খুব দ্রুত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি আলাদা স্থানে কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার কথা ছিল। এরকম বহু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আমাদের চোখের সামনেই হয় এবং কিছুই হবে না ভেবে মেনেও নেই। তবে দুর্ঘটনা ঘটার পর আর করার কিছুই থাকে না। 

পুরান ঢাকার মানুষের কাছে ক্রমেই তাদের এই দুর্ঘটনাগুলো উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। এই উদ্বেগের কারণ ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। আগুনের ভয়াবহ বিস্তারের পেছনে যে কেমিক্যাল দায়ী যদি তা সরিয়ে নেয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আর কোন নিমতলী বা চকবাজারের মতো হৃদয়বিদারক ঘটনার স্বাক্ষী হতে হবে না দেশবাসীকে। এসব ঘটনার পাশাপাশি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসকে বেগ পেতে হয়েছে আরও কয়েকটি কারণে। তার কয়েকটি হলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির প্রবেশমুখ সরু, ঘটনাস্থল থেকে পানির উৎসের দূরত্ব। যে কোনো স্থানেই অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যাতে সহজেই আগুন নেভানোর কাজটি করতে পারে তার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে বাড়িঘর তৈরি করতে হবে। এর আগেও জলাশয়ের অভাবে আগুন নেভানোর কাজ তরান্বিত করা যায়নি। কেমিক্যাল পল্লী সরিয়ে নিতে হবে সবার আগে। অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে।


লেখক : অলোক আচার্য, সাংবাদিক ও কলাম লেখক



মন্তব্য করুন