বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আনন্দ বেদনার ঈদ

অলোক আচার্য
১১ মে ২০২১ ১৭:৫৬ |আপডেট : ১১ মে ২০২১ ২৩:০০
অলোক আচার্য, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
অলোক আচার্য, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এখন মহামারিকাল চলছে। করোনাকালের মধ্যেই গত বছর দুটো ঈদ চলে গেছে। এ বছরের ঈদ-উল-ফিতরও করোনা প্রকোপের মধ্যেই এসেছে। সারা বিশ্বে মৃত্যু ঘটেছে ৩২ লাখেরও বেশি মানুষের। আর আক্রান্ত কোটি কোটি। করোনা ভাইরাসের নতুন নতুন ষ্ট্রেইন বিপদে ফেলছে। ঈদ আনন্দ হয়ে এসেছে এর মধ্যেই। মানুষ ছুটছে গ্রামের বাড়িতে। করোনা ঝুঁকি উপেক্ষা করেই মানুষের এই আনন্দ যাত্রা। সবাই জানে এই আনন্দ যাত্রাতে কি পরিমাণে ঝুঁকি আছে এবং তা যেকোনো সময় দেশের জন্যও হুমকি হতে পারে। তারপরও হাজার হাজার মানুষের ভিড়। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে যাবে মানুষ থেকে মানুষে। অনেক সমস্যার মধ্যেই প্রশান্তি ছড়িয়েছে। সেই সাথে থাকবে শংকাও। মোট কথা গতবারের মতোই এবারেও ঈদ আনন্দ বেদনার মিশ্রণ।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি। আর এই ধাক্কা যাচ্ছে মূলত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর দিয়ে। হাতে অর্থ নেই। ঈদের নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্যও নেই অনেক পরিবারের। করোনায় কর্ম হারিয়েছে অনেক মানুষ। ফলে এই ঈদটা তাদের কাছে আরও বেশি কষ্টকর। আর কতটি ঈদ আমাদের এভাবে উদযাপন করতে হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ করোনার সহসাই বিদায় নেওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। যতই টিকা প্রয়োগ হোক না কেন করোনা মোকাবেলায় জোর দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনা চলার ওপর। সত্যি কথা বলতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা থাকলেও বাস্তবিকপক্ষে স্বাস্থ্যবিধির বালাই খুব একটা নেই। মাস্ক ব্যবহারের কথা থাকলেও এই স্বাস্থ্যবিধি প্রায়ই চোখে পরে না। আইন মেনে চলার প্রবণতা আমাদের প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে করোনার প্রকোপ দ্রুতই যাচ্ছে না। 

পৃথিবীতে একটি মহাসংকট চলছে। চলমান মহামারিতে বিপর্যস্ত পৃথিবী। অতীতের মহামারিগুলোতেই বিপুল মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আবার পৃথিবী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এই মহামারিকালের বছরগুলোর ঈদ অন্যসব বছরের ঈদের থেকে আলাদা। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। করোনা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য একটু পার্থক্য থাকবে। মনে আনন্দের ছোঁয়া দিয়ে যাবে কিন্তু একটু অন্যরকমভাবে। মানুষ মানুষের জন্য। পৃথিবীতে এ এক মহাসত্য বাণী যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে মানুষের পাশে এনে দাড় করিয়েছে। আর আজ যখন মানুষ করোনার মহামারীতে মারা যাচ্ছে তখনো মানুষ মানুষের পাশে দাড়িয়েছে। লাখ লাখ প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহর্তে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। কোথায় গিয়ে এর তাণ্ডব থামবে তা হয়তো কারোরই জানা নয়। তবে একসময় তা শান্ত হবে। এর আগের মহামারিগুলোতে তাই হয়েছে। প্লেগ বা সার্স বা এরকম যত মহামারি এসেছে সবই একসময় চলে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বন্ধ হবে তখন আমরা যে বিশ্ব পাবো সেই বিশ্ব কেমন হবে? উত্তর হলো সেই বিশ্ব ও মানবিক হবে। করোনা ভাইরাসের মহামারি থেকে রক্ষা পেতে দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ঘরে থাকাই যে এই ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র ভালো উপায়। তাই মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। 

বিশ্বের জন্য নভেল করোনাভাইরাস এক বিরাট ধাক্কা। এই ধাক্কা যে কেবল এই কয়েকদিনেই শেষ হবে তা বলা যায় না। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি দরিদ্র, অসহায় আর খেটে খাওয়া দিনমজুর যারা আজ উপাজর্নহীন জীবন যাপন করেছে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে সবাই। বাংলাদেশ, ভারত সব দেশেই দেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগ সবাই আজ এসব মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে- এ কথারই সত্যতা জানান দিচ্ছে। কিন্তু তাতেই সমস্যার শেষ হচ্ছে না। আপাতত সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে মাত্র। করোনাভাইরাসের প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদী। যার প্রধান শিকার হবে এসব দরিদ্র মানুষই। এসব দরিদ্র মানুষের সাথে আরও দরিদ্র মানুষ যোগ হবে। অর্থ্যাৎ আর মানুষ দরিদ্র হবে। 

বেকারত্ব ও দারিদ্রতা ঘিরে ধরছে পৃথিবীকে। উল্লেখযোগ্য হারে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এর প্রভাব পরছে মানুষের জীবন যাপন, ক্রয় ক্ষমতায়। মানুষ বাধ্য হচ্ছে জীবন যাপনের মানে পরিবর্তন আনতে। অনেকেই হয়তো অন্যান্য ঈদের মতো কেনাকাটা করতে পারেনি। কারণ আর্থিক সংকট। করোনায়  লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝরে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই সংখ্যা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে এই তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। কোথায় গিয়ে এর তান্ডব থামবে তা হয়তো কারোরই জানা নয়। তবে একসময় তা শান্ত হবে।  জীবন জীবিকা দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা যায় না। কিন্তু এখন সবকিছু চললেও তা অনেকটাই থেমে থেমে। অনেকে যা সঞ্চয় করেছিল তাও কারো কারো শেষ হওয়ার পথে। ফলে ভবিষ্যতে কি হবে তার উত্তর অনেকের কাছেই নেই। সমাজের বিত্তবানরা হতদরিদ্রদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব মানুষের সংখ্যা নেহায়েত অল্প নয় যে তা রাতারাতি সবাইকে করা সম্ভব হবে। বেকারত্ব ঘিরে ধরছে এবং সেই সাথে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে। চাকরি হারানোর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যা দারিদ্রতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলছে। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর করোনা যেন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা। করোনাকালে পরিবর্তন হচ্ছে পেশা,জীবন ও জীবিকা। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা অনেকেই চাকরি হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। শহরের জীবন ফেলে ফিরছেন গ্রামের জীবনে। খরচ বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক চাকরিজীবির বেতন কমে গেছে বা একেবারেই পাননি।

যারা বাসা ভাড়া করে থাকতো তারা বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে কেবল বাসা ভাড়ার খরচ বাঁচাতে। সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা তৈরি করতে হচ্ছে। অনেক কর্মহীন মানুষ বিকল্প কর্ম খুঁজে নিয়েছে। আর হয়তো তার সেই পেশায় ফেরা হবে না। হয়তো তার সন্তান যে স্কুলে পড়ালেখা করতো সেখানে আর তারা পড়তে পারবে না। করোনা ভাইরাস পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবিকায় প্রভাব ফেলছে। এই প্রভাব পরছে মূলত নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের জীবন যাত্রায়। ফলে মানুষ জীবন যাপন প্রক্রিয়া বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে চাকরিচুত্যি, কম বেতনে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই যেন করোনাকালে একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর্থিক সংকট মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে। ক্রয় ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে। পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক কেনা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হবে না। ফলে সেই পরিবারগুলোর মধ্যে আনন্দের মাঝেও লুকিয়ে থাকবে কষ্ট। সেই কষ্ট বাইরে থেকে দেখা যাবে না। কিন্তু এই দুঃসময় ঠিক কেটে যাবে। আবার ঈদ আসবে। তখন আবার পৃথিবী আগের মতো চলতে শুরু করবে। তখন ঈদের আনন্দের সাথে বেদনা থাকবে না। তখন থাকবে কেবল আনন্দ। 

 



মন্তব্য করুন