শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উনপঞ্চাশেও অরক্ষিত সিলেটের দুটি বধ্যভূমি

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:১১ |আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২১ ২০:১১
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে

স্বাধীনতার উনপঞ্চাশ বছরেও অরক্ষিত সিলেটের বড় দুটি বধ্যভূমি। আটচল্লিশ বছেরও এ দুটি বধ্যভূমি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অবহেলা আর উদাসীনতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। এই দুই বধ্যভূমির কোনোটিতেই নেই পতকা উত্তোলনের বেদি। নামফলক বা সাইনবোর্ডের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

বধ্যভূমি দুটি সিলেট শহরতলির বড়শালা সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনের কাকুয়ারপাড় টিলা ও দক্ষিণ সুরমা পারাইরচক লালমাটিয়া এলাকায় অবস্থিত। সেখানে দুই সহস্রাধিক মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যার পর গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা।


কাকুয়ারপাড় বধ্যভূমি

টিলাবেষ্টিত স্মারকস্তম্ভ। স্থানটিতে অসংখ্য নারীদের গণকবর। এখানে নারীদের ধরে এনে শ্লীলতাহানী করে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ এই স্থানটিতে একটি স্মারকস্তম্ভ তৈরি করেই দায়সারা। স্থানটিতে অসংখ্য গণকবর থাকলেও কোনো শহীদরেই নামফলকের কোনো চিহ্ন নেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্মারকস্তম্ভের পাশেই গার্ড ওয়াল তৈরির কাজ করছে কয়েজন নির্মাণ শ্রমিক। তাদের পরিহিত জামা কাপড়, খাবার সামগ্রি এলোমেলো করে রাখা হয়েছে স্মারকস্তম্ভের উপরে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছ ময়লা-আবর্জনা। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে ঘুমিয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকেও জীবন্ত করে রাখতে হবে।

স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সিলেট ক্যাডেট কলেজে (তৎকালীন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল) ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি। সেখানে বহু নারী মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যার পর মরদেহ ফেলে দেওয়া হতো পেছনের টিলার জঙ্গলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরও এসব এলাকায় মানুষের হাড়, মাথার খুলি পড়ে থাকতে দেখেছেন স্থানীয়রা। গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি শিগগিরই সেখানে নামফলক স্থাপনের দাবি জানান তিনি।

জানা যায়, টিলাভূমির প্রায় ১১ দশমিক ৪৮ শতক জায়গায় রয়েছে গণকবর। সিলেট ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০০৭ সালে পুরো জায়গাটি চিহ্নিত করে। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করে। পরের বছর ২৩ নভেম্বর প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষে বিজয় দিবস থেকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু করে।

লালমাটিয়া বধ্যভূমি

সেখানে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ও চৌকি। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে এই বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হায়েনারা। আর তাদের সহোযোগীতা করে এদেশীয় রাজাকার-আলবদররা। স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধা জানান, সে সময় পাকিস্তানি হানাদাররা শহরের লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সেখানে হত্যা করত। এরপর সেখানে গণকবর দিত। একেকটি গণকবরে ১৫ থেকে ২০ জন করে মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে।

তিনি আরও জানান, সেসময় প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সারি সারি গণকবরে চাপা দেওয়া হয়েছিল মুক্তিকামী অগণিত বাঙালির মরদেহ। অনেকের মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল সড়কের বাম পাশের কচুরিপানা ভর্তি ডোবায়। গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে সেখানে অতি শিগগিরই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধা জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদাররা এখানে তাঁবু টাঙিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলো। শুধু এ অঞ্চলের মানুষই নয়, শহরমুখী লোকজনকে দূর-দূরান্ত থেকে ধরে এনে হত্যা করে গণকবর দিতো তারা। তিনি বলেন, প্রায় আধা কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গণকবর। এসব গণকবরে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিলো পাকিস্তানী সেনারা। এ বধ্যভূমি সংরক্ষণে সরকারি বিভিন্ন দফতরে বিভিন্ন সময় দাবি জানানো হয়েছে।

বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড সিলেট জেলা শাখার সভাপতি মো. সালাউদ্দিন পারভেজ জানান, প্রথমে বধ্যভূমিগুলো চিন্থিত করতে হবে। পাশাপাশি সংরক্ষণ ও দেখভাল করার জন্য নৈশ প্রহরী নিয়োগ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘লালমাটিয়ার বধ্যভূমিটি সম্পর্কে কেউই জানতো না। পরবর্তীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড সাটানো হয়। এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে আমরা একাধিকবার জেলা প্রশাসক বরাবারে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদেক্ষপ নেওয়া হয়নি।’ 

এ প্রসঙ্গে, সিলেট জেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল জানান, সিলেটের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি দক্ষিণ সুরমার লাল মাটিয়া। অনেক উদ্যোগ নিয়েও এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা যায়নি। কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি সাইনবোর্ড সাটানো হয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা আর স্থানীয় প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। অনেক চেষ্টা করেও আমরা বারবার ব্যর্থ হয়েছি। তিনি বলেন, ‘কাকুয়ারপাড় এলাকার বধ্যভূমিতে সিলেট ক্যাডেট কলেজের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেটিও অরক্ষিত। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।’

এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি আগে ইউএনও ছিলাম। এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’



মন্তব্য করুন