সোমবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইন্দিরা দেবী : রবীন্দ্রনাথের মানসসঙ্গী

রাফিয়া মাহমুদ প্রাত
১৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩৭ |আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২১ ০১:৫৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী

শিরোনামটি দেখে পাঠকদের কী মনে হতে পারে? ইন্দিরা দেবী হয়তো রবীন্দ্রনাথের প্রেয়সীসম কেউ ছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা দেবী তা নন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী।

সংস্কৃতির বাহক ও ঐতিহ্যবাহী পরিবার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কন্যা এই ইন্দিরা দেবী। ১৮৭৩ সালে বিখ্যাত ঠাকুর বংশে যার জন্ম। মা জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন একজন বিদুষী নারী এবং উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত। বাবা ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী এবং বিদ্যানুরাগী।

 

ইন্দিরা দেবী; ছবিসূত্র : banglapedia.org

ইন্দিরা দেবী ঠাকুর পরিবারে মেয়েদের মধ্যে ছিলেন প্রথম বিএ পাস  করা কন্যা। ১৮৯২ সালে বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘পদ্মাবতী’ পদক লাভ করেন।

ইন্দিরা দেবী একাধারে ছিলেন সংগীতশিল্পী, লেখক, অনুবাদক, সমাজ সংস্কারক। ছোটবেলা থেকেই তিনি তার সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় দিয়ে এসেছিলেন। অবশ্য তা না হলে কবিগুরু ইন্দিরাকে যে ভাষায় পত্র লিখতেন তার রস আস্বাদন করতে হয়তো পারতেন না ইন্দিরা দেবী।

অনুবাদক

অল্পবয়সেই ইন্দিরা দেবী একজন অনুবাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি থেকে অনেক পত্রিকা বের হতো। এরকমই এক পত্রিকা ‘বালক’  ছিল রবীন্দ্রনাথ দ্বারা পরিচালিত এবং মাতা জ্ঞানদানন্দিনী দ্বারা সম্পাদিত। ইন্দিরা দেবী প্রথম সেখানেই তার অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরে ফারসি শিখে রেনে গ্রুসের ভারতবর্ষ, পিয়ের লোতির কমল কুমারিকাশ্রম এবং মাদাম লেভির ভারতভ্রমণ কাহিনী অনুবাদ করেন।

চাচা রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, গল্পসহ ‘জাপানযাত্রীর ডায়েরী’র ইংরেজি অনুবাদও তিনি প্রকাশ করেন। ইন্দিরা দেবীর সবথেকে বড় পরিচয় তিনি একজন অনুবাদক।

সঙ্গীতজ্ঞ

ইন্দিরা দেবী পিয়ানো, বেহালা, সেতারবাদন এবং রবীন্দ্রসংগীতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে সুরকার এবং গীতিকার। রবীঠাকুরের  ‘স্বরলিপি’  রচনা তার এক অমর কীর্তি। তাছাড়াও ‘কালমৃগয়া’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘মায়ার খেলা’  প্রভৃতিসহ আরও দুশো রবীন্দ্র সঙ্গীত তিনি রচনা করেছেন। এছাড়াও চাচার বহু স্বরলিপি গ্রন্থের সম্পাদক ছিলেন ইন্দিরা দেবী।

তার দেওয়া সুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক সংগীত রচনা করেছেন। নারীদের সংগীতসংঘের মুখপাত্র ‘আনন্দ সংগীত’ পত্রিকার তিনি ছিলেন অন্যতম যুগ্ম সম্পাদিকা। রবী ঠাকুরের মৃত্যুর পর তিনি শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে সেখানে নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাদান করতেন।

লেখক

খুব ছোট বয়স থেকেই সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মেছিল ইন্দিরার মনে। অবশ্য তার মূলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ইন্দিরা দেবী বলে গেছেন,

‘কাকু আজীবন আমাদের সাহিত্য, সংগীত এবং চিত্রকলা শেখার জন্য উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন। তার শেষ জীবনের প্রান্ত ভাগে এসে সেই চিত্রকলাকে প্রাণপণের আঁকড়ে ধরেন নিজস্ব চিন্তাধারা দিয়ে। চিত্রকলার কিছু আদিরূপ অংকনে তিনি আমাদের নিয়োজিত করে গেছেন।’

ইন্দিরা দেবী কয়েকটি মৌলিক রচনা হলো –

·    শ্রুতি স্মৃতি

·    রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেনী সঙ্গম

·    রবীন্দ্রস্মৃতি

ইন্দিরা দেবী সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-

·       নারীমুক্তি

·       বাংলার স্ত্রী আচার

·       স্মৃতিকথা

·       পুরাতনী

·       গীতি পঞ্চশতী 

পরবর্তীকালে বাম্বোধিনী, বঙ্গলক্ষ্মী, সাধনা, পরিচয়, সবুজপত্র প্রভৃতি পত্রিকায় সংগীত ও সাহিত্যবিষয়ে তার অনেক মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয়। বাঙালি নারীর মঙ্গল-অমঙ্গল বিষয়ে তার মতামত ‘নারীর উক্তি’ নামক প্রবন্ধে বিধৃত হয়েছে।

সমাজ সংস্কারক

লেখক, অনুবাদক, সাহিত্যক, সংগীতশিল্পী এ সবকিছুর পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারে, সামাজিক উন্নয়নেও অনেক অবদান রেখে গেছেন। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথ ধরেই তিনি ‘মহিলা শিক্ষা লীগ, সর্ব ভারতীয় মহিলা সম্মেলন, সংগীত সঙ্ঘ, সংগীত সম্মেলনসহ আরও নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে চলে আসার পর ‘আলাপনী মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা ও তার মুখপত্র ‘ঘরোয়া’ প্রকাশ করেন। মহিলা কল্যাণে গঠিত ‘বেঙ্গল উইমেন্স এডূকেশন লীগ’, অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স, ‘হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রম’ ইত্যাদি সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন তিনি।

প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক

প্রমথ চৌধুরী তখন সবেমাত্র ব্যারিস্টারি পাস করে প্র্যাক্টিস শুরু করেছেন। তার পান্ডিত্য এবং সাহিত্যপ্রীতির কথা জানতে পারেন ঠাকুরবাড়ির লোকেরা। অপরদিকে তার অগ্রজ আশুতোষ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসঙ্গী। সাহিত্যানুরাগী হওয়ায় পরবর্তীতে প্রমথ চৌধুরীর সাথে  রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

   ‌ 

ইন্দিরা দেবী এবং প্রমথ চৌধুরীর পত্রাবলী; ছবিসূত্র : cloudfront.net

আর এভাবেই তিনি  আইনজীবী প্রমথ চৌধুরী থেকে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধরীতে পরিণত হলেন। ইন্দিরা দেবী যাকে ১৮৯৯ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। উনিবিংশ শতাব্দীর মতো গোঁড়া একটি সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকেও তিনি (ইন্দিরা দেবী) নিজ পছন্দে বিয়ে করেছিলেন। বিখ্যাত ‘সবুজপত্র’ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক এই প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তার স্বনির্বাচিত বর, যাকে আমরা রবীন্দ্রনাথের জামাতা বলে চিনি।

রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবী

সেই শৈশব থেকেই ইন্দিরা দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল এক অটুট বন্ধনে গাঁথা। ভাতিজীকে রবীন্দ্রনাথ কতটা স্নেহ করতেন তা বোঝা যেত ইন্দিরাকে পাঠানো তার চিঠিগুলো দেখলেই!

রবী ঠাকুরের সাহিত্যকর্মের অন্যতম এক শাখা হলো তার পত্র সাহিত্য। প্রায় ২২টি জায়গা থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি এই পত্রগুলো লিখেছিলেন। সবচেয়ে বেশি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে। আর সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখতেন ভাতিজি ইন্দিরাকে। রবীন্দ্রনাথের সেসব চিঠির খণ্ডাংশ নিচে তুলে ধরলে বোঝা যাবে ইন্দিরা দেবীর আসন তার চাচার কাছে কতটা অতুলনীয় ছিল!

তিনি লিখেছিলেন,

‘অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক থেকে আলো বাতাস আসছেযেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই।বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের—বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর— সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়। কেন জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে।আমার এই, সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার  গল্পটা লিখেছিলুম। ’

এই সকল চিঠিতে উপস্থিত থাকত তার (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের)  কল্পনা, ভাবনা, ব্যাকুলতা, আকাঙ্ক্ষা, ধ্যানধারণা, মানুষজন, নদনদী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক সাবলীল উপস্থাপন।


ইন্দিরা দেবী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ছবিসূত্র : steemitimages.com

রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লিখছেন,

‘তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি। তোকে আমি যখন লিখি, তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি।’

চিন্তা চেতনা, ভাব-আদর্শের দিক থেকে রবিঠাকুরের সাথে তার এতটাই মিল ছিল যে তাকে রবিঠাকুরের ভাবশিষ্যা বলা হতোরবী ঠাকুর তাকে ভালোও বাসতেন খুব। উপরে বর্ণিত ইন্দিরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অংশটুকুতে তিনি তার আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নিজের মনের অনুভূতি যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তা থেকে উপলব্ধি করা যায় ইন্দিরা দেবী শুধু আদরের ভাতুষ্পুত্রী নয় তার মানসসঙ্গীও  ছিলেন।


পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইন্দিরা দেবীর গ্রন্থ; ছবিসূত্র : blogspot.com

 

তথ্যসূত্র-

https://bangla.newsnextbd.com/ইন্দিরা-দেবী-চৌধুরানী-ঠা/


https://m.newsg24.com/abroad-news/3010/ইন্দিরা%20দেবী%20চৌধুরানীর%20প্রয়ান%20দিবস%20আজ


https://www.chintasutra.com/2017/12/ছিন্নপত্রে-ইন্দিরা-দেবী/


আরও পড়ুন-

একাত্তরে বিদেশি সাংবাদিকদের বলিষ্ঠ ভূমিকা
কেন ভূতে বিশ্বাস করে মানুষ?
পৃথিবীর ভূমিবিহীন একমাত্র দেশ ‘সিল্যান্ড’



মন্তব্য করুন